নারিকেল এর উপকারিতা
ফল হিসেবে নারিকেলের অবস্থান অনন্য এক তালিকায়, একইসাথে পিপাসা এবং
ক্ষুধা নিবারণ করে ফলটি। গ্রীষ্মকালের কাঠফাটা রোদে এক গ্লাস ডাবের পানি
যেন অমৃত। আমাদের বাঙালিদের পিঠা-পায়েস নারিকেল ছাড়া যেন অকল্পনীয়। গ্রামে
গেলে এমন একটি বাড়ি খুঁজে পাওয়াও দুষ্কর, যেখানে গেলে আপনাকে মুড়ি আর
নারিকেলের নাড়ু দিয়ে আপ্যায়ন করবে না। একমাথা ঝলমলে সুন্দর চুলের জন্য যেমন
নারিকেলের তেলের বিকল্প নেই, ঠিক একইভাবে লাবণ্যময় এবং স্বাস্থ্যোজ্জ্বল
ত্বকের জন্য নারিকেল তেলের তুলনা হয় না।
নারিকেলের পানি বা নারিকেল
থেকে তৈরি মজাদার সব খাবার নিয়ে নয়, আজকের লেখাটি নারিকেলের এক বিশেষ অংশ,
এর শাঁসের সব রকম স্বাস্থ্য উপকারিতা নিয়েই সাজানো।
নারিকেলের পুষ্টিগুণ
নারিকেলের শাঁসের স্বাস্থ্য উপকারিতা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনার আগে আপনাদের জানাবো নারিকেলের পুষ্টিগুণ সম্পর্কে। দারুণ স্বাদের এই নারিকেল শাঁস কেবল খেতেই সুস্বাদু নয়, বরং এটি আমাদের শরীরের জন্য দরকারি নানা পুষ্টিগুণে পরিপূর্ণ।
নারিকেলের শাঁস ভিটামিন বি১, বি২, বি৩, বি৫, বি৬, বি৯, প্রোটিন, ফ্যাট,
কার্বোহাইট্রেড, ক্যালসিয়াম, আয়রন, ম্যাগনেসিয়াম, ফসফরাস, জিংক, পটাশিয়াম
এবং পর্যাপ্ত ক্যালরিতে পরিপূর্ণ থাকে। নারিকেলের মূল পুষ্টি উপাদানগুলো
নিয়ে এখন চলুন জানা যাক।
মিডিয়াম চেইন ফ্যাটি অ্যাসিড
এক কাপ
কাঁচা নারিকেলের শাঁসে ২৮৩ ক্যালরি থাকে যার অধিকাংশ ২৬.৮ গ্রাম ফ্যাট
থেকে আসে। যেখানে অন্যান্য উদ্ভিজ্জ খাবারে খুব সামান্য ফ্যাট থাকে, সেখানে
নারিকেলের প্রতি কাপে থাকে ২৮০ গ্রাম। তবে সবচেয়ে দারুণ ব্যাপারটি হলো,
নারিকেলের ফ্যাটের সবটাই মিডিয়াম চেইন ফ্যাটি অ্যাসিড যা লং চেইন ফ্যাটি
অ্যাসিডের চেয়ে কয়েকগুণ বেশি দ্রুত শরীরে মিশে যায়। ফলে এটি হাই
কোলেস্টেরলে কোনো অবদান রাখে না। দ্য ফিলিপাইন জার্নাল অফ কার্ডিওলোজির
তথ্য অনুযায়ী নারিকেলের উপস্থিত ফ্যাট আমাদের শরীরের জন্য খারাপ কোলেস্টেরল
কমিয়ে ভালো কোলেস্টেরলের মাত্রা বৃদ্ধিতে সহায়তা করে। তবে হ্যাঁ, আপনার
যদি হৃদরোগ বা হাই কোলেস্টেরল থাকে, সেক্ষেত্রে নারিকেল বা অন্য যেকোনো
খাদ্য যাতে ফ্যাট আছে, সেসব খাবার গ্রহণের আগে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া
উচিৎ।
ফাইবার
নারিকেলের শাঁস হাই ফাইবারে পরিপূর্ণ, ১ কাপ নারিকেলের শাঁসে ৭.২ গ্রাম
ফাইবার থাকে। ফাইবার খাবার হজম করতে সাহায্য করে এবং সামান্য খাবারেও
আপনাকে বেশি খাওয়ার তৃপ্তি দেয়। তাই যারা ওজন কমানোর জন্য কম কিন্তু
পুষ্টিমান সম্পন্ন খাবার খেতে চান, তাদের জন্য নারিকেলের শাঁস প্রকৃতির
আশীর্বাদ স্বরূপ। ‘দ্য সেন্টার ফর নিউট্রিশন পলিসি অ্যান্ড প্রোমোশন’ থেকে
জানানো হয়, “প্রতি ১হাজার ক্যালরির জন্য ১৪গ্রাম ফাইবার সমৃদ্ধ খাবার
আমাদের গ্রহণ করা উচিৎ, মানে প্রতিদিন প্রত্যেক শিশুর ১৭ থেকে ২৫ গ্রাম এবং
প্রাপ্ত বয়স্কদের ২৫ থেকে ৩৬ গ্রাম ফাইবার গ্রহণ করা বাঞ্ছনীয়।”
ম্যাঙ্গানিজ
নারিকেল রক্তে গ্লুকোজ এবং ইনসুলিন সিক্রেসন উন্নত করে। নারিকেল ডায়াবেটিসে আক্রান্ত ব্যক্তির
রক্তে সুগারের মাত্রা নিয়ন্ত্রণকারী হরমোনকে ইতিবাচকভাবে প্রভাবিত করে
ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ করে এবং ধীরে ধীরে রক্তে সুগারের মাত্রা কমিয়ে আনে। এ
কারণেই নারিকেল ডায়াবেটিস আক্রান্ত মানুষের জন্য একটি দারুণ কার্যকরী
খাদ্য।
রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি
আমাদের শরীরে রোগ
প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে নারিকেলের পুষ্টিমান অতুলনীয়। এটি অ্যান্টি-ভাইরাল,
অ্যান্টি-ফাঙ্গাল, অ্যান্টি-ব্যাকটেরিয়াল এবং অ্যান্টি-প্যারাসাইটিক
উপাদান সম্পন্ন। নারিকেল আমাদের শরীরে ভাইরাস ও ব্যাকটেরিয়া প্রতিরোধ
ক্ষমতা কয়েক গুণ বাড়িয়ে তোলে। শুধু এগুলোই নয়, কাঁচা নারিকেল খেলে আমাদের
গলার ইনফেকশন, মূত্রনালির ইনফেকশন, ফিতাকৃমি এবং শ্বাসনালীর প্রদাহের মতো
বাজে ধরনের রোগগুলো থেকে রক্ষা পাওয়া সম্ভব।
পেটের অতিরিক্ত মেদ/চর্বি কমায়
পেটের অতিরিক্ত মেদ বা চর্বি কমাতে
নারিকেলের তুলনা নেই। যাদের পেটে অস্বাভাবিক চর্বি বা মেদ থাকে তাদের
প্রায়ই বিভিন্ন শারীরিক সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়। এক্ষেত্রে প্রতিদিন মাত্র
২০০ গ্রাম নারিকেল মাত্র ১২ সপ্তাহে পেটের মেদজনিত সমস্যা ও কোমরের
অতিরিক্ত চর্বি কমাতে সাহায্য করে।
শক্তি বর্ধক
নারিকেল আমাদের শরীরের ফ্যাট পুড়িয়ে শারীরিক শক্তি বৃদ্ধি করে।
যেখানে অন্যান্য খাবারে হাই ফ্যাটি অ্যাসিড থাকে সেখানে নারিকেলে থাকে
মিডিয়াম চেইন ফ্যাটি অ্যাসিড। এই ফ্যাটি অ্যাসিড অনেক বেশি স্বাস্থ্যকর
কারণ অন্যান্য ফ্যাটি অ্যাসিডের মতো এটি হজমের জন্য লিভারের প্রয়োজন পড়ে
না। ফলে শরীরে শক্তি সঞ্চিত থাকে আর শরীর তাৎক্ষণিক শক্তিও পায়। নারিকেল
আমাদের থাইরয়েডের কাজ ঠিকভাবে চলতে সাহায্য করে এবং দীর্ঘস্থায়ী
ক্লান্তিদায়ক উপসর্গগুলো থেকে মুক্তি দেয়।
হৃদরোগ প্রতিরোধ
নারিকেলে হাই ফ্যাট আছে কিন্তু সেটা অন্যান্য খাবারে উপস্থিত ক্ষতিকর
ফ্যাটের মতো নয়, যেমন ট্রান্স-ফ্যাট। নারিকেলের দুধে পাওয়া ফ্যাট গরুর দুধে
থাকা ফ্যাটের তুলনায় হালকা, ফলে ধমনীতে ক্লোজ সৃষ্টি হওয়ার সম্ভাবনা কম।
তাই হৃদরোগীদের জন্য গরুর দুধের চেয়ে নারিকেলের দুধ বেশি স্বাস্থ্যকর।
নারিকেলের শাঁসে উচ্চমাত্রায় মনোগ্লিসারাইড উপাদান রয়েছে যা শরীরে জমে
থাকার বদলে শরীরের শক্তি বর্ধকের কাজ করে, যা আমাদের হৃদযন্ত্রের জন্য
উপকারী।
গর্ভবতী মায়েদের জন্য নারিকেল সুপার ফুড
গর্ভাবস্থায় নারিকেল একটি অপরিহার্য পুষ্টি সমৃদ্ধ খাবার।
গর্ভবতী মা এবং বাচ্চার সুস্বাস্থ্য বজায় রাখার জন্য একে সুপার ফুডও বলা
যায়। নারিকেলের লিউরিক অ্যাসিড হবু মায়ের বুকের দুধের সঞ্চালন বাড়ায় এবং
গর্ভকালীন মায়ের জয়েন্টের ব্যথা কমায়। এছাড়া নারিকেলে থাকা ভিটামিন ই
গর্ভবতী মায়েদের জন্য অবশ্য প্রয়োজনীয় পুষ্টি উপাদান। সুস্থ-সবল বাচ্চা
জন্মদান এবং গর্ভধারণকালীন অসুস্থতা দূরে রাখতেও নারিকেলের গুরুত্ব
অপরিসীম। গর্ভাবস্থায় বমি বমি ভাব, বুক জ্বালা পোড়া ও গ্যাস্ট্রিকের সমস্যা
দূর করতে প্রতিদিন সকালে নারিকেলের শাঁস বা শুকনো নারিকেলের শাঁস অথবা
নারিকেলের দুধ পান করতে পারেন হবু মায়েরা।
ক্যান্সার প্রতিরোধ
নারিকেলের
পুষ্টিগুণ ক্যান্সার প্রতিরোধক উপাদান বহন করে বলে প্রমাণিত। ব্রেস্ট
ক্যান্সার এবং কোলন ক্যান্সার প্রতিরোধে এটি বিশেষ অবদান রাখে।
ব্লাড সার্কুলেশন
আমাদের শরীরের কোষগুলোতে সঠিকভাবে ব্লাড সার্কুলেশন
করাতে অক্সিজেনের কোনো বিকল্প নেই। নিয়মিত নারিকেল খেলে ত্বকে অক্সিজেন
সরবরাহের ক্ষমতা বেড়ে যায় এবং সঠিক ব্লাড সার্কুলেশন বজায় থাকে। সঠিক ব্লাড
সার্কুলেশন আমাদের ত্বকের সুস্বাস্থ্য বজায় রাখে এবং ত্বক সুন্দর রাখে।
সুস্থ হাড় এবং দাঁত
নিয়মিত নারিকেল খেলে আমাদের দেহের হাড় এবং দাঁতের সুস্বাস্থ্য
বজায় থাকে। নারিকেল শরীরের ক্যালসিয়াম এবং ম্যাঙ্গানিজ শোষণের ক্ষমতা
উন্নত করে, যা হাড়ের উন্নয়নে সহায়তা করে। এটি আমাদের শরীরের হাড়কে পাতলা
ও ভঙ্গুর করে তোলা অস্টিওপোরোসিস প্রতিরোধ করে। এমনকি যাদের শরীরে
ল্যাকটোজ ঘাটতি রয়েছে, নারিকেল তাদের ল্যাকটোজের ঘাটতির পরিপূরক হিসেবেও
কাজ করে।
স্ক্যাল্প ইনফেকশন রোধ
নারিকেলের অ্যান্টি-ফাঙ্গাল ও
অ্যান্টি-ব্যাকটেরিয়াল উপাদান মাথার ত্বকের চুলকানি, ইনফেকশন, এমনকি
মাথার উকুন সমস্যার সমাধান করে। মাথার ত্বক সুস্থ রেখে এটি চুলের গ্রোথ
বাড়ায়।
Comments
Post a Comment